বাংলাদেশে অর্কিড চাষ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বাংলাদেশে অর্কিড চাষ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
পরিচিতি ও ব্যবহার
ফুলের রাজ্যে অর্কিড এক অনিন্দ সুন্দর ফুল। এর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। ফুল উৎপাদনোক্ষম উদ্ভিদ জগতে অর্কিড একটি বিশাল পরিবার যার প্রায় ৯০০ গণ এবং ৩০,০০০ এরও অধিক প্রজাতি রয়েছে। আকর্ষণীয় রঙ, বিভিন্ন ধরনের গড়ন, সুগন্ধ, ঔষধি গুণাগুণ, দীর্ঘ স্থায়িত্বকাল এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অর্কিড ফুলের গঠন বৈচিত্র্যে বিস্মিত হয়ে প্রাচীন চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস ‘একে সেরাফুল’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। দার্শনিক প্লেটো, এরিস্টোটল, থিওফ্রাসটাস আদর করে এ ফুলের নাম দিয়েছিলেন অর্কিস। কালক্রমে এ নামটিই বিবর্তিত হয়ে অর্কিড হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তর প্রজাতির অর্কিড জন্মাতে দেখা যায়। যে কারণে এর আদি বাসস্থানও এক জায়গায় সীমাবদ্ধ নেই। হিমালয়ের পূর্বাংশে ঘাসিয়া পাহাড়, বাংলাদেশের সিলেট জেলার উত্তরে পাহাড়ি অঞ্চল, থাইল্যান্ড, বার্মা, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, ফিলিপিনস, মেস্কিকো, দক্ষিণ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার উষ্ণ অঞ্চলে অর্কিড পাওয়া যায়। এই ফুল অর্কিডেসি পরিবারের সদস্য। ফুলদানিতে দীর্ঘকাল সজীব থাকে বলে কাটফ্লাওয়ার হিসেবে এর ব্যবহার সর্বাধিক। এ ছাড়া ছোট অবস্থায় এর গাছও শোভা বৃদ্ধি করে।  

অর্কিডের শ্রেণী ও জাত
চাষ পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে অর্কিড প্রধানত ২ প্রকার।
পার্থিব বা  Terrestrial

যেসব অর্কিড অন্যান্য ফুলের মতো মাটিতে জন্মায় এবং সেখান থেকে খাদ্য ও রস সংগ্রহ করে, তাদের পার্থিব অর্কিড বলে। এদের সুতার মতো সরু গুচ্ছ মূল থাকে। যেমন- ফায়াস, সিমবিডিয়াম, লেডি স্লিপার ইতাাদি।

পরাশ্রয়ী বা Epiphytic
যেসব অর্কিড অন্য কোন গাছের শাখা বা কাণ্ডের উপর আশ্রিত হয়ে জন্মে তাদের পরাশ্রয়ী অর্কিড বলে। এদের লম্বা, মোটা ও পুরু মূল থাকে, বাতাস থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। যেমন ডেনড্রোবিয়াম, ভ্যান্ডা, এরিডিস ইতাাদি।
Growth habit এর ওপর ভিত্তি করে অর্কিড আবার ২ প্রকার

সিমপোডিয়াল (Sympodial)
প্রতি বছর Pseudobulb হতে অথবা কাণ্ডের গোড়া হতে শাখা বের হয় এবং শাখার অগ্রভাগ থেকে ফুল উৎপাদিত হয়। যেমন- ফেলেনপসিস, ক্যাটেলিয়া, ডেনড্রোবিয়াম, অনসিডিয়াম, সিমপোডিয়াম উল্লিখিত প্রজাতি।

মনোপডিয়াল (Monopodial)
একটি লম্বা কাণ্ড থাকে যা প্রতি বছর প্রতি ঋতুতে বর্ধনশীল অংশ থেকে পাতা এবং পত্রাক্ষ থেকে ফুল উৎপাদনের মাধ্যমে লম্বায় বাড়তে থাকে। যেমন- ভ্যান্ডা, এরিডিস, রিনকোস্টাইলিস ইত্যাদি।

জলবায়ু ও মাটি
সাধারণত উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া অর্কিড চাষের জন্য উত্তম। প্রজাতি ভেদে ১০-৩০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় অর্কিড ভালো জন্মে। আধো আলোছায়া এরূপ স্থান ফুল চাষের জন্য নির্বাচন করা উচিত। Terrestrial বা পার্থিব শ্রেণীর জন্য দো-আঁশ মাটি ব্যবহার করা উচিত। এ ছাড়া উপযুক্ত বায়ু চলাচল এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।

বংশবিস্তার
যৌন ও অযৌন উভয় পদ্ধতিতেই অর্কিডের বংশবিস্তার করা যেতে পারে। যৌন পদ্ধতিতে বংশবিস্তার কষ্টসাধ্য বলে অযৌন উপায়েই সচরাচর এর বংশবিস্তার করা হয়ে থাকে। সাধারণত অফসেট, ডিভিশন, কেইকিস এবং কাটিংয়ের মাধ্যমে অংগজ বংশবিস্তার করা হয়ে থাকে। ডেনড্রোবিয়াম এবং এপ্রিডেনড্রাম শ্রেণীর অর্কিডে কেইকিসের মাধ্যমে বা অফসেট আলাদা করে ছোট পটে লাগিয়ে চারা তৈরি করা যায়। সাধারণত ফেব্রুয়ারি মাসে যখন গাছের  বৃদ্ধি নতুন করে শুরু হয় তখনই অংগজ বংশবিস্তারের উপযুক্ত সময়। এছাড়া টিস্যু কালচারের মাধ্যমে সফলতার সঙ্গে ডেনড্রোবিয়াম, সিমবিডিয়াম, ফেলেনপসিস ও ক্যাটেলিয়ার অসংখ্য চারা উৎপাদন করা যায়। সংকরায়নের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন অথবা চারার বর্ধনশীল অঙ্গ বা নোড হতে চারা উৎপাদন প্রতিটি ক্ষেত্রেই টিস্যুকালচার ল্যাবরেটরির মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হয়। উৎপাদিত চারাগুলোর মূল গজানোর পর ল্যাব হতে বের করে স্বল্পালোক ও অধিক আর্দ্রতায় চারাগুলোকে প্রায় দু’সপ্তাহ রেখে সহনশীল করতে হয়। পরবর্তীতে প্রায় ৬ মাস ‘থাম্ব পটে’ নারিকেলের ছোবড়ার মধ্যে রেখে পরিচর্যার মাধ্যমে একটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে হয়। ‘থাম্ব পটে’ চারাগুলো ৪-৬ ইঞ্চি বড় এবং প্রচুর শিকড় সমৃদ্ধ হয়ে কমিউনিটি পটে প্রয়োজনমাফিক নারিকেলের ছোবড়া (Hask) অথবা কাঠকয়লা দিয়ে স্থানান্তর করতে হয়।

চাষ পদ্ধতি
পার্থিব বা  Terrestrial  অর্কিড
টব, গামলা বা ঝুলন্ত বাস্কেটে চাষ করা যেতে পারে। এগুলোর যে কোনো একটির ভেতরের তলদেশে কয়লা, খোয়া অথবা ঝামার টুকরা স্থাপন করতে হয় এবং এর উপরে নারিকেলের ছোবড়ার টুকরা ছড়িয়ে দিতে হয়। এরপর প্রয়োজনমতো পানি সেচ দিতে হয়। অতিরিক্ত পানি প্রয়োগ সব সময় পরিহার করা বাঞ্ছনীয়।

পরাশ্রয়ী  বা Epiphytic অর্কিড
বিশেষ ধরনের টব কাঠের বা মাটির টবে পাশে ও নিচে বড় বড় ছিদ্রসহ অথবা বাঁশের ঝুড়িতে চাষ করা যায়। মরা কাঠের ওপর জন্মানোর ক্ষেত্রে আম, জারুল বা কড়ই গাছে রশি দিয়ে সঙ্গে নারিকেলের ছোবড়াসহ বেঁধে দেয়া যেতে পারে।

ক্রমপ্রসারমান আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য অথবা কাট ফ্লাওয়ারের উৎপাদন খরচ কমানোর লক্ষ্যে কমিউনিটি পটের পরিবর্তে বিছানা পদ্ধতিতে ডেনড্রোবিয়াম প্রজাতির চাষ এখন বাংলাদেশ উৎসাহিত হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে মাটি থেকে ৬০ সেমি. উঁচুতে ১ মি. চওড়া ও প্রয়োজনমাফিক লম্বায় কাঠ, বাঁশ অথবা অন্য কোন উপাদান দিয়ে মাচা তৈরি করা হয়। ওই মাচায় নারিকেলের ছোবড়া স্থাপনপূর্বক ৪টি সারিতে ডেনড্রোবিয়াম প্রজাতির অর্কিড গাছ প্রতি বর্গমিটার ৪০টি হারে স্থাপন করা হয়। এ পদ্ধতিতে প্রথম বছর ২০% গাছে একটি করে ফুল, দ্বিতীয় বছর ১০০% গাছে ৩-৪টি করে ফুল, তৃতীয় বছর ৪-৫টি করে ফুল উৎপাদিত হতে দেখা যায়। তৃতীয় বছর ফুল ছাড়াও অর্কিডের প্রচুর চারা উৎপাদিত হয় যা বিক্রয়যোগ্য।

সেচ ও সার
অর্কিডের চারদিকে বাতাস সব সময় আর্দ্র রাখতে হয়। অর্কিড গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য চা চামচের এক-চতুর্থাংশ (১/৪ অংশ) প্রতি সারের যেমন ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি এক লিটার পানির সাথে গুলিয়ে ১০-১২টি গাছে স্প্রে করা যায়। সার গুলানো পানি গাছের পাতা, ডগা ও শিকড়সহ (নারিকেলের ছোবড়া) সব জায়গায় স্প্রে করতে হবে। ইউরিয়া সার খুব সহজে পানিতে গুলে যায়। কিন্তু টিএসপি ও এমওপি পানিতে গুলতে বেশ সময় নেয়। এজন্য দানাদার টিএসপি ও এমওপি এক লিটার পানির জন্য পরিমাণমতো গুঁড়ো করে নিতে হবে। তারপরও সবগুলো সার পানিতে দেয়ার পর নিচে কিছু তলানি পাওয়া যাবে। এজন্য সারগুলো পানিতে গুলানোর পর, কিছু সময় অপেক্ষা করে আলতোভাবে ওপর থেকে পরিষ্কার পানিটুকু স্প্রে করার জন্য ঢেলে নিতে হবে। সাধারণভাবে অর্কিড গাছে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ফুল দেয়া আরম্ভ হয়। তখন থেকে সারের মাত্রায় কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়। ফুল দেয়ার সময় চা চামচের এক-দশমাংশ (১/১০) ইউরিয়া, এক চামচ টিএসপি ও এক-চতুর্থাংশ (১/৪) এমপি সার এক লিটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে ১০-১২টি গাছে স্প্রে করা যায়। বাজারে অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক তরল সার যেমন Phostrogen, OhioW.P. দ্রবণ পাওয়া যায়। তবে লক্ষ রাখতে হবে যেন কোনো ক্রমেই অতিরিক্ত পানি সিঞ্চন করা না হয়। সাধারণত অর্কিডের শারীরিক বৃদ্ধির জন্য ২০-১০-১০ আনুপাতিক হারে নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশের দ্রবণ প্রতি সপ্তাহে একবার করে স্প্রে করতে হয়। গাছের বৃদ্ধির প্রতি লক্ষ রেখে নাইট্রোজেনের পরিমাণের তারতম্য হতে পারে। পূর্ণবয়স্ক গাছে ফুল ফোটা ত্বরান্বিত করার জন্য ২০-২০-২০ হারে উল্লিখিত সারগুলো প্রয়োগের সুপারিশ করা যায়।

অর্কিডের রোগ-পোকা
টব, কন্দ, শিকড় সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা চাই। ১০-১৫ দিন পর পর গাছে-সেভিন পাউডার ছড়িয়ে দেয়া  উচিত। তাহলে পিঁপড়া, পোকামাকড়ের উপদ্রব থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। আঁশ পোকা ও মাকড়সার উপদ্রব দেখলে সাবান পানি ছিটানো উচিত। থ্রিপস, মিলিবাগ ও এফিডের জন্য ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি ২ মিলি. হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-৮ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। ইঁদুরের উপদ্রব হলে বিষটোপ ব্যবহার করা যেতে পারে। পাতায় ও পেটালের ব¬াইট রোগ হলে আক্রান্ত পাতা ও পেটাল পচে যায়। রোগাক্রান্ত হলে প্রতি লিটার পানির সঙ্গে ০.৫ মিলি. টিল্ট অথবা চা চামচের আধা চামচ ডাইথেন এম-৪৫ ভালোভাবে পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৭-১০ দিন পর পর গাছে স্প্রে করতে হবে। ০.৫ মিলি. টিল্ট মাপার জন্য অনেক সিরাপ জাতীয় ওষুধের সঙ্গে ড্রপার দেয়া থাকে, তার সাহায্যে মাপা যাবে। নেমাটোড আক্রান্ত গাছের চারপাশে ফুরাডান ছিটিয়ে দেয়া উচিত। চাষের যন্ত্রপাতি শোধন করে ব্যবহার করা ভালো।

ফুল সংগ্রহ
সারা বছর জাতভেদে অর্কিডের ফুল ফোটে তবে দেশীয় অর্কিড মার্চ-মে মাসে সর্বাধিক পাওয়া যায়। কিছু কিছু ডেনড্রোবিয়াম অর্কিড বছরে ২-৩ বার ফোটে। প্রতি গাছে জাতভেদে ২-৪টি স্টিক পাওয়া যায়। খুব সকালে অথবা বিকেলে ফুলের নিচের কুঁড়ি ২/১ টা ফোটা মাত্রই কাটা উচিত। ফুলের স্থায়িত্বকাল বাড়ানোর জন্য ২-৩% সুক্রোজ কার্যকরী। বৃষ্টির সময় অথবা ভেজা অবস্থায় ফুল চয়ন করা উচিত নয়। ফুল সংগ্রহের পর পরই এর ডাটার গোড়া পানিতে ডুবিয়ে রাখলে ফুল বেশি দিন সতেজ থাকে।

বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাবনা
ফুলের বিশ্বব্যাপী চাহিদা ক্রমান¦য়ে বেড়েই চলেছে। এটা এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এক উল্লেখযোগ্য পণ্য যার মূল্য হাজার হাজার কোটি ডলার। পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল উৎপাদিত হয়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফুলের উৎপাদন ও বিপণন ক্রমে ক্রমে শিল্পপণ্য উৎপাদনসম বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে, যাকে এখন ‘পুষ্পশিল্প’ বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এ শিল্পের সর্বাধিক বিকাশ ঘটেছে হল্যান্ডে। হল্যান্ড প্রতি বছর ফুল, বাহারি গাছ ও সংশ্লিষ্ট দ্রব্য রপ্তানি করে ৯০০০ মিলিয়ন ট$ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। হল্যান্ড নিজেদের উৎপাদিত এবং বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত বাহারি গাছ অন্যান্য দেশে রপ্তানি করে। বাংলাদেশের উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু নানা রকম অর্কিড ফুল উৎপাদনের উপযোগী। উল্যাহ এবং হেরেথ (২০০২) এর সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশ বিভিন্ন অর্কিড ফুল ও গাছ যেমন- ডেনড্রোবিয়াম, অনসিডিয়াম, মোকারা, ভ্যান্ডা, ক্যাটেলিয়া, এরিডিস, ফেলেনপসিস এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর দাবি রাখে। পুষ্পশিল্পের সর্বাধিক উন্নয়ন হয়েছে গত পঞ্চাশ বছরে এবং এতে কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, থাইল্যান্ড প্রতি বছর বিশ্বের ৫০টি দেশে কমপক্ষে চার কোটি ডলার মূল্যের অর্কিড রপ্তানি করে। ভারত, মালয়শিয়া, তাইওয়ান, শ্রীলংকা, সিঙ্গাপুরও অর্কিড ফুল রপ্তানিতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ফুলচর্চার ক্ষেত্রে বাংলাদেশেও কিছু কিছু অগ্রগতি হয়েছে। দেশের সব এলাকায় বহুসংখ্যক নার্সারি গড়ে উঠেছে। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় এখন মানুষ নার্সারিতে গেলে ফলের চারা ক্রয়ের সাথে সাথে দু-একটি ফুলের চারাও ক্রয় করে নিয়ে আসে। দেরিতে হলেও ১৯৮২-৮৩ সন থেকে বাংলাদেশে অর্থকরী ফসল হিসেবে ফুল উৎপাদন ও ফুলের ব্যবসায় শুরু হয়েছে। এক সমীক্ষায় জানা গেছে, বাংলাদেশে এখন প্রায় ১০,০০০ হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হয়। প্রাপ্ত তথ্য মতে, শুধু মাত্র ঢাকা শহরেই ৫০-৫৫টি স্থায়ী এবং ২০০-২৫০টি অস্থায়ী দোকান রয়েছে যার প্রতিটি দোকানের প্রতিদিনের গড় বিক্রি ৪০০০-৫০০০ টাকা। প্রাপ্ত তথ্য মতে, বাংলাদেশে ২০০৮ সনে ফুলের রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৩৭৬ কোটি টাকা এবং বছরে আনুমানিক ৪ কোটি টাকার ফুল বেচাকেনা হয়।

প্রাপ্ত সূত্র মতে, সবুজে ভরপুর আমাদের এ উষ্ণমণ্ডলীয় দেশে প্রায় ৮০টির অধিক অর্কিড প্রজাতি রয়েছে। অধুনা অর্কিড সোসাইটি, কিছু এনজিও, প্রাইভেট নার্সারি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেমন- BRAC, PROSHIKA, SQUARE, Kingshuk Nursery, Dipta Orchid Ltd., Micro Orchid Ltd., Omni Orchid Ltd., Energypac Agro. Ltd., Duncan Brothers Bangladesh Ltd., Alpha Agro. Ltd., Wonderland Toys, Krishibid Orchid and Cactus Nursery, Krishibid Upakaran Nursery, Sabuj Nursery, Hortus Nursery, Kashbon Nursery, Ananda Nursery এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে দেশি-বিদেশি জাতের অকির্ড পাওয়া যায়, যা বিদেশে রপ্তানিযোগ্য। এছাড়া বছরের বিভিন্ন সময়ে বৃক্ষমেলা, পুষ্পমেলা, অর্কিডশো এমনকি কৃষি মেলাতেও কিছুকিছু শৌখিন প্রদর্শনকারী তাদের স্টলে বাহারি জাতের কিছু অর্কিডের সমাবেশ ঘটান- যা সত্যিই প্রশংসনীয়।

এক সময় হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে কোন অর্কিডই ছিল না, সে দেশের প্রাচীন মানুষ কখনো অর্কিড দেখেনি। প্রথমে শখের বাগান, তারপর শুরু হয় অর্কিডের বাণিজ্যিক চাষ। এরপর ধীরে ধীরে হাওয়াই হয়ে ওঠে অর্কিডের স্বপ্নরাজ্য। আর ওদের পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তেমনি এখন পেছনে তাকানোর সময় নেই অর্কিডের রানী থাইল্যান্ড ও তাইওয়ানের। বিশ্বে এখন অর্কিডের সবচেয়ে বড় বাজার বসে তাইওয়ানে। তাইওয়ান এখন বিশ্বে সবচেয়ে বড় অর্কিড রপ্তানিকারক দেশ। প্রতি বছর মার্চে তাইওয়ানে তাইওয়ানিজ ইন্টারন্যাশনাল অর্কিড শো অনুষ্ঠিত হয়। সেটি বিশ্বের প্রধান তিনটি অর্কিড শোর একটি। সিঙ্গাপুরেও সম্প্রতি গড়ে তোলা হয়েছে সিঙ্গাপুর বোটানিক গার্ডেনের মধ্যে একটি ন্যাশনাল অর্কিড গার্ডেন। মালয়েশিয়ার ক্যামেরুন হাইল্যান্ডে আছে অনেক অর্কিড গার্ডেন। তারা শুধু বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই অনসিডিয়াম, ডেনড্রোবিয়াম, ফেলেনপসিস ইত্যাদি উৎপাদন করছে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ডেনড্রোবিয়াম অর্কিড উৎপাদনকারী দেশ থাইল্যান্ড আমেরিকার প্রয়োজনের বৃহদাংশ (৯৭%) সরবরাহ করে থাকে। কোটি কোটি ডলার তারা শুধু অর্কিড বাণিজ্য করেই উপার্জন করছে। অর্কিড চাষ তাই থাইল্যান্ডে শিল্পের মর্যাদা লাভ করেছে। এসব দেখে ও জেনে মনে হয় আমাদের যে অর্কিড সম্পদ রয়েছে সেগুলো নিয়েও আমরা ওদের মতো অনেকটা পথ এগিয়ে যেতে পারি। বৃহত্তর সিলেট, বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, যশোর, রাজশাহী অর্কিডের জন্য সম্ভাবনাময় এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

রপ্তানিযোগ্য বাংলাদেশে অভিযোজনক্ষম অর্কিডগুলো : ফুলের ব্যবহার কোন দেশ বা জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। আর্থিক দিক থেকে যে জাতি যত সমৃদ্ধ, সে জাতির কাছে ফুলের কদরও তত বেশি। বর্তমানে অনেক দেশ শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্ডিয়ায় অর্কিডের বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে এবং এ বিশেষ ক্ষেত্রটি দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিশ্ব এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে ফুলের চাহিদা অনুসারে সরবরাহ কম। তাই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশে ফ্লোরিকালচার শিল্প গড়ে তুলতে পারলে লাখ লাখ লোক আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে, অপরদিকে অভ্যন্তরীণ ফুলের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।
 
 
ড. কবিতা আনজু-মান-আরা*
খাইরুল কবির**
ড. এস এম শরিফুজ্জামান***
*ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফুল বিভাগ, উগকে, বারি, গাজীপুর **প্রভাষক, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ***প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফুল বিভাগ, উগকে, বারি, গাজীপুর